কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ধারণা। কৃষ্ণবস্তু নামটি শুনলে মনে করতে পারো এটি হয়তো কালো একটি বাক্স বা সেরকম কিছু। আসলে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। পরমশূণ্য তাপমাত্রার উপরে প্রায় সববস্তুই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ বিকিরণ করে। যেমন একটি লোহার রডকে যদি প্রচন্ড গরম করো তাহলে সেটি আলো (অর্থাৎ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ) বিকিরণ করা শুরু করে, এটি তাপীয় বিকিরণের একটি উদাহরণ। যদিও সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ কিন্তু আমরা খালি চোখে দেখতে পারি না তবে পরীক্ষাগারে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সাহায্যে সেগুলো পরিমাপ করা যায়। সাধারণভাবে কোন বস্তুর উপর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ পরলে কিছুটা প্রতিফলিত হয়, কিছুটা শোষিত হয় আর কিছুটা বিকিরিত হয়। ১৮৬০ সালে Gustav Kirchhoff আবিস্কার করেন যে কিছু কিছু বস্তু রয়েছে যেগুলো আপতিত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গগুলিকে পুরোপুরি শোষণ করে ফেলে, কোন তরঙ্গই প্রতিফলিত করেনা কিন্তু আপতিত সকল তরঙ্গ বিকিরণ করে; অর্থাৎ এদের absorption coefficient, । তিনি এধরনের বস্তুর নাম দেন কৃষ্ণবস্তু।
কৃষ্ণবস্তুর তাপীয় বিকিরণের বর্ণালী তার তাপমাত্রা ও আপতিত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে [1] । একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কৃষ্ণবস্তু সব থেকে বেশি তাপীয় বিকিরণ করে থাকে; সূর্য এরকম একটি কৃষ্ণবস্তুর উদাহরণ। কৃষ্ণবস্তুর ধারণা সে সময় পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় গবেষনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। Ferdinand Kurlbaum, Otto Lummer, Werner Pringsheim, Heinrich Rubens ও Wilhelm Wien সহ অনেকেই কোমড় বেধে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ নিয়ে গবেষনা শুরু করেন। ১৮৯৫ সালে বিজ্ঞানী O. Lummer ও W. Wien প্রস্তাব করেন যে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটি ফাপা বাক্স বা গোলকের ভেতরে তাপীয় বিকিরণ, Kirchhoff এর প্রস্তাবিত কৃষ্ণবস্তুর মতো আচরণ করে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, একটা বড় বাক্স নিয়ে তার গায়ে একটা খুব ছোট ছিদ্র করলে। ছিদ্রের ভেতর দিয়ে আলো প্রবেশ করার পর সেটি বাক্সের গায়ে প্রতিফলিত হতে হতে একসময় পুরোপুরি শোষিত হয়ে যাবে। সুতরাং ফাপা বাক্সটি থেকে বিকিরিত তরঙ্গ অনেকটা কৃষ্ণবস্তুর তাপীয় বিকিরণের মতই আচরণ করবে।
আলট্রাভায়োলেট বিপর্যয়
১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানী W. Wien পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গাণিতিকভাবে কৃষ্ণবস্তুর তাপীয় বিকিরণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন; যেটি Wien's formulation নামে পরিচিত [2]। বছর তিনেক পরে ১৮৯৯ সালের দিকে বিজ্ঞানী O. Lummer এবং W. Pringsheim সঠিকভাবে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ পরিমাপ করতে সফল হন। কিন্তু তাঁরা দেখতে পান যে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের ক্ষেত্রে Wien's formulation গবেষনার ফলাফলের সাথে মিললেও উচ্চ তাপমাত্রায় বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের ক্ষেত্রে Wien's formulation কাজ করছে না [3]। পরবর্তীতে ১৯০০-১৯০৫ সালের দিকে বিজ্ঞানী Lord Rayleigh আর Sir James Jeans পরিসংখ্যানিক বলবিজ্ঞান ব্যবহার করে আল্ট্রাভায়োলেট বিকিরণের শক্তির ঘনত্ব হিসাব করার একটি সূত্র প্রদান করেন-
[পুরো ক্যালকুলেশন দেখতে এখানে ক্লিক করো!]
কিন্তু তাপমাত্রা নির্দিষ্ট থাকলে এর মানের কোন পরিবর্তন হবে না অর্থাৎ ধ্রুবক থাকবে। সুতরাং উপরের সমীকরণকে লিখতে পারো এভাবে - অর্থাৎ
কিন্তু দেখা যায় বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে গবেষনা থেকে পাওয়া কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের হিসাবের সাথে মিলছে না, বরং এটি অসীমে চলে যাচ্ছে অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় Rayleigh-Jeans এর সূত্রটি কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের হিসাব ঠিকঠাক করতে পারছিলো না। মোদ্দাকথা কৃষ্ণবস্তুর বিকিরিত রশ্মি যতই আল্ট্রাভায়োলেট রশ্নির কাছাকাছি যাচ্ছিলো ক্লাসিক্যাল কোন তত্ত্বই সেটির ব্যাখ্যা দিতে পারছিলো না; এই ঘটনাকে আলট্রাভায়োলেট বিপর্যয় বলা হয়।
Planck এর তত্ত্ব
এরই মধ্যে ১৯০০ সালের দিকে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী Max Planck কৃষ্ণবস্তুর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণের বর্ণালীগুলোকে নতুন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। ধরাযাক কৃষ্ণবস্তুটি একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা তে রাখা হয়েছে। এবং কৃষ্ণবস্তুর আশেপাশে আর কোন শক্তির আদান-প্রদান ঘটছে না। তাহলে নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি ( গ্রীক অক্ষর, উচ্চারণ 'nu' )-তে ওই কৃষ্ণবস্তুটি যে শক্তি () বিকিরণ করবে সেটি হবে
এবং তিনি আরও উল্লেখ করেন যে কৃষ্ণবস্তুটি ক্রমাগতভাবে শক্তি বিকিরণ করবে না বরং এই শক্তির মানগুলো বিচ্ছিন্ন (বা Quantized) হবে। এই সমীকরণে একটি পূর্ণ সংখ্যা Integer আর কে বলা হয় Planck এর ধ্রুবক; এবং এর মান ।
[1]: Translated by F. Guthrie from Annalen der Physik: 109, 275-301 (1860): G. Kirchhoff (July 1860). "On the relation between the radiating and absorbing powers of different bodies for light and heat". The London, Edinburgh, and Dublin Philosophical Magazine and Journal of Science. 20 (130).
[2]: W. Wien: Ann. Phys. 294, (1896) 662−669
[3]: O. Lummer and E. Pringsheim, Transactions of the German Physical Society 2 (1900), p. 163